চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিবিরের সাবেক সভাপতি শিহাব আহম্মেদের প্রশংসা করে কৃতজ্ঞতা জানালেন সনাতনধর্মের আরেক শিক্ষার্থী এপি আদিত্য। তিনি তার ফেসবুক পোস্টে লিখেন,
ছাত্র শিবিরের রং ও রূপ:
২০০২-২০০৩ শিক্ষাবর্ষে আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হই। বিশ্ববিদ্যালয় কেউ পরিচিত না থাকায়,আমাদের ডিপার্টমেন্টের এক বড়ো ভাইয়ের (প্রসীদ চক্রবর্তী) সহোযোগিতায় শহরের ০২ নং গেটে, অর্থাৎ,ষোলশহরে আলফাল্লাহ্ গলীর কাজী মঞ্জিলের পঞ্চম তলায় স্থান পেলাম। আমি-সহ আরও পাঁচ জন ছাত্র ঐ ফ্লাটে থাকতাম। তৎকালীন সময়ে আমাদের প্রতিজনের কাছ থেকে ৮০০ টাকা করে বাসা ভাড়া নেওয়া হতো। ওখানে থাকা খাওয়া সহ আমার প্রতিমাসে ২৪/২৫শ টাকা খরচ হতো।
আমি দরিদ্র ঘরের সন্তান, তৎকালীন সময়ে আমার পক্ষে ঐ টাকা ম্যানেজ করা বেশ কষ্ট সাধ্য ছিলো। মনে মনে চিন্তা করলাম এই জায়গা ত্যাগ করবো, কিন্তু বললেই তো আর হবেনা,কম দামের বাসা খুঁজতে হবে তো।
শুরু করলাম কম দামের বাসা খোঁজা,কিন্তু পেলাম না কোথাও। মাঝে মাঝে টাকা সল্পতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসায় ফেরার পথে,হল থেকে খেয়ে যেতাম (তখন হলে খাবার বিল ছিলো মাত্র ০৮ টাকা)। প্রতিদিন দুপুরে হলে খেতে যাওয়ার কারণে শহ্-আমানত হলের ডাইনিং-এ কর্মরত একজন ওয়েটারের সাথে আমার বেশ খাতির জন্মে। সে আমাকে খুবই ভালোবাসতেন (ভাইয়ের নামটা আজ মনে করতে পারছি না)। তিনি মাঝে মাঝে ম্যানেজারের চোখের আড়ালে গোপনে একটুকরো মাংস,কিংবা কিছু সব্জি আমার পাতে দিয়ে যেতেন। আমি নিষেধ করা সত্ত্বেও,তিনি দিনের পর দিন এই কাজটি করেই যেতেন।
একদিন আমাকে তিনি বললেন যে–
দাদা আপনি হলে উঠে আসেন। শুরু হলো আমার হলে উঠার অভিযান। তাঁর কথামতো আমি হলে আবেদন করলাম। যেহেতু আমি মানবিক বিভাগের ছাত্র, সেহেতু আমি সোহরাওয়ার্দী হলে আবেদন করলাম। প্রথম বর্ষের ছাত্র বিধায় আমি হলে সিট পেলাম না।
এদিকে প্রাচ্যভাষা (বর্তমান সংস্কৃত ভাষা) বিভাগের ছাত্র আমি। একেবারে গুরুগম্ভীর ভাষা, ক্লাসে তেমন কিছুই বুঝিনা। সিদ্ধান্ত নিলাম ওখানে পড়াশোনা করবো না বাড়িতে চলে আসবো এবং এলাকার কলেজে ডিগ্রি পড়বো।
তাই–
আমার যা-কিছু পোঁটলা/পুঁটলী৷ ছিলো সবকিছু নিয়ে বাড়িতে চলে আসলাম,এই সংবাদ পেলো,আমার গ্রামের এক জ্যাঠু মহাশয়( প্রায়াত বাবু মনীন্দ্রনাথ বৈরাগী, সাবেক চেয়ারম্যান নাজিরপুর ইউনিয়ন পরিষদ) এবং আমার বর্তমান কর্মরত কলেজের উপাধ্যক্ষ জনাব মুজিবুর রহমান বালী স্যার। তাঁরা আবার আমাকে বাড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য তাড়িয়ে দিলেন,বললেন বড়ো মাছের নাকি কাঁটার ভাগও ভালো।
সুতরাং,আবার ফিরে গেলাম প্রিয় শিক্ষাভূমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
কিন্তু থাকার জায়গা তো নেই, পরলাম মহা বিপদে। এমতাবস্থায় স্টুডিও ইউনিভার্সিটির মালিক নকুল দেবনাথ,নিরিবিলি হেয়ার ড্রেসারের মালিক জীতেন চন্দ্র দাস এবং জিয়া ফটোস্ট্যাটের মালিক, মো:জিয়াউর রহমান ভাই তাঁদের দোকানে মাস খানেকের মতো রাখলেন।
ঠিক এই একমাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের কাছে বিনীত ভাবে অনুরোধ,উপরোধ করা শুরু করলাম। প্রথমেই ছাত্রলীগের কাছে গেলাম,তারা হলে সিট দিবে দিবে করে আজ কাল করে দিনের পর দিন সময় ক্ষেপণ করলেন।
মাঝে মাঝে তাদের চাহিত অনুসারে আমার দুর্বল পকেট থেকে চা,সিগারেট, কেক ইত্যাদি খাওয়াতাম। কিন্তু হলে সিট আর দিতে পারলেন না। বিরক্ত হয়ে,গেলাম ছাত্র দলের কাছে। তাদের উপকারও তথৈবচ।
যাইহোক কয়েকদিন তাদের পিছনে ঘোরার পরে, ছাত্র দলের সভাপতি সেলিম ভাই( লালিয়ার হাট বাড়ী) আমাকে একটা পরামর্শ দিলেন, আমি যেন সোহরাওয়ার্দী হলে শিহাব আহম্মেদ নামে একটা ছেলে আছে তার কাছে গিয়ে আমার সকল সমস্যার কথা খুলে বলি। আমি গেলাম তাঁর কাছে।
তিনি নাম পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন।আমি আমার পরিচয় দিলাম।আমার বাড়ি পিরোজপুরে শুনে বেশ আদর করলেন তিনি। তিনি আমাকে চিঁড়ের মোলা আর জল খেতে দিলেন,পরে বললেন, আমি যেন,গেস্ট রুমে অপেক্ষা করি। আমি গেস্ট রুমে গিয়ে বসলাম,দেখলাম সেখানে আদিবাসী ছাত্র-সহ বেশ কয়েকজন ছাত্ররা বসে আছেন।
কিছুক্ষণ পরেই শিহাব ভাই গেস্ট রুমে আসলেন, সকলে দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান জানালেন, আমিও জানালাম। প্রথমেই তিনি বললেন অমুসলিম ছাত্রদের সমস্যাগুলো আগে বলেন। প্রথমে কয়েকজন আদিবাসী ছাত্ররা তাদের সমস্যার কথা বললেন।এবার আমার পালা।আমি বললাম ভাই আমার একটা সিটের প্রয়োজন।আমি যদি হলে সিট না পাই তাহলে আমার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে।
তিনি প্রশ্ন করলেন আমি ছাত্রাবাসে সিটের জন্য আবেদন করেছি কি-না।
আমি বললাম– করেছি।
তবে লিস্টে নাম আসেনি। তিনি আমার সকল সমস্যার কথা শুনে আমাকে বললেন,আর কয়েকটি দিন যেন ঐ দোকানে(স্টুডিও ইউনির্ভাসিটি ও নিরিবিলি হেয়ার ড্রেসারে) থাকি। তিনি চেষ্টা করবেন এই বলে আমাকে আস্বস্ত করে বিদায় দিলেন। ঠিক সাতদিন পরেই শুনতে পেলাম যে,ওয়েটিং লিস্ট থেকে সোহরাওয়ার্দী হলে আমার সিট হয়ে গেছে। আমার বরাদ্দকৃত কক্ষ নং ১১৬।
আমি হলে উঠে গেলাম।
পরে জানতে পারলাম তিনি আমাদের তৎকালীন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিবিরের সভাপতি,জনাব শিহাব আহম্মেদ । শুধু এখানেই শেষ নয়,তাঁর সম্পর্কে বলতে গেলে খুব কমই বলা হয়ে যায়। সত্যি একজন মহান মানুষ তিনি।
আমি নিয়মিত পড়াশোনা করছি কি-না ?
ক্লাস নিয়মিত করছি কি-না ?
কি খাচ্ছি ?
টাকা পয়সা আছে কি-না ?
বাড়িতে বাবা মা কেমন আছেন ? সকল কিছুরই তিনি খবরাখবর রাখতেন।
আমি হিন্দু বলে, আমাকে ঘৃণা করেন নি।
আমার ভালো রেজাল্টের পিছনে তাঁর গৌণ ভুমিকা ছিলো অপরিসীম। যেটা তখন আমি বুঝতে পারিনি,এখন অনুভব করি।
প্রার্থনা করি তিনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন।ঈশ্বর তাঁর মঙ্গল করুন ।
Leave a Reply