মকবুল হোসেন: আলহামদুলিল্লাহ। বেশ কয়েক বছর যাবত দেখতেছি ধর্মীয় পড়াশোনার ক্ষেত্রে মানুষের আগ্রহ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে হাফিজিয়া মাদ্রাসার প্রতি মানুষের আগ্রহের প্রবণতা অনেক বেশি ।এটা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য এবং বাস্তবসম্মতও বটে।
আমাদের দেশের মাদ্রাসা শিক্ষার দুটি ধারা অতী প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে একটি হল আলিয়া অপরটি কওমি।
আলিয়া মাদ্রাসার ক্ষেত্রে ক্লাস ভিত্তিক কোরআন শিক্ষার যে ব্যবস্থা এটা মোটেই সন্তোষজনক নয়। সপ্তাহে তিন দিন বা চার দিন ৩0 মিনিট বা ৪০ মিনিট কোরআন সম্মিলিতভাবে শেখানোর যে প্রক্রিয়া এটা দিয়ে সহি শুদ্ধভাবে কুরআন শিক্ষা আদৌ সম্ভব কিনা যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। তবে যাদের পিতা-মাতা নিজ থেকে ভাল পারেন তাদের জন্য এটা হতো কার্যকরী হতে পারে। কিন্তু যাদের পিতামাতা কোরআন পড়তে পারেনা তাদের ছেলেমেয়েদেরকে এ ব্যবস্থায় কোরআন শেখানো কঠিন।
আরো বেশ কয়েক বছর আগে বিশেষ করে ৯০ এর দশকে আমরা দেখেছি মক্তবগুলিতে গ্রুপ গ্রুপ করে করে কোরআন শেখানো হতো। তখন আমাদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা থাকতো। সূর্য আগে উঠে না আমরা আগে মক্তবে যাই। সূর্য ওঠার আগে মক্তবে যাওয়া লাগতো, কেউ পড়ে গেলে তার জন্য কৈফত দিতে হতো ।কিন্তু বর্তমানে কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই শিফট চলার কারণে খুব সকালেই বাচ্চাদেরকে অন্য প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যেতে হয়।এ জন্য মক্তবগুলির সে আগের মত প্রাণ নেই। ফলে কোরআন শিক্ষার ব্যবস্থাটা অনেকটাই সংকুচিত হয়ে আসছিল। এর অভাবটা পূরণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন জায়গায় হাফিজিয়া মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে তারা বিরাট একটা ভূমিকা পালন করছে।
কিন্তু ভাববার বিষয় হচ্ছে এতগুলি মাদ্রাসার যে গড়ে উঠছে বা যারা এখানে পরিচালনা করছেন বা যারা পড়াচ্ছেন তারা সকলেই কি একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে সামর্থ্যবান কিনা? অথবা যারা শিক্ষকতা করছেন তারা শিক্ষক হওয়ার যোগ্য কিনা? যোগ্যতা বা সক্ষমত যাচাই বাছাই করেএবং কোনো সংস্থা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নিয়ে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সিস্টেম এখানে নেই। যে কেউ ইচ্ছা করলে একটা মাদ্রাসা খুলে বসে পড়েন এবং তারা তাদের মতন করে মাদ্রাসা পরিচালনা করেন।
একটা ছেলে অথবা মেয়েকে কোন ক্লাস থেকে ভর্তি করতে হবে অথবা কত বছর বয়স হলে সে এখানে ভর্তি হতে পারবে এই ক্ষেত্রে বিধিবদ্ধ কোন নিয়ম নেই। দু একটা ব্যতিক্রম ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে যখন নিয়ে যাচ্ছে সিট খালি থাকলে ছেলে মেয়েদেরকে ভর্তি করানো হচ্ছে। বয়সের কোন বাধ্যকতা নেই। ফলে বয়সের বিস্তর তফাৎ হচ্ছে একই ক্লাসে ।
এতে করে অনেক ইমমিচিউড বাচ্চা ম্যাচিউর বাচ্চার সাথে ওঠাবসার কারণে বেশ কিছু জটিলতা দেখা দেয়।
মাদ্রাসাগুলিতে ভর্তি হওয়ার পর কতদিন পর্যন্ত সে হাফেজি পড়তে পারবে বা পড়তে হবে এর নির্দিষ্ট কোন সময়সীমা নাই। কোনো একজন শিক্ষার্থী আদৌ হাফিজি পড়তে পারবে কি না? তারও কোনো বিচার বিশ্লেষণ নেই।
ভর্তি হয়েছি তাই, পড়তেছি তো পড়তেছি ই ।দেখা গেছে কারো বয়স ১৭ বছর ১৮ বছর এমনকি ২০ বছর হয়ে গেল এখনো সে হাফেজী পড়তেই আছে। এসব বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে সে উচ্চশিক্ষা কোন লাইনে কিভাবে করবে এই ব্যাপারে না কোনো ছাত্রও বুঝে ?
না কোনো গার্ডিয়ান বা ওস্তাদের চিন্তা আছে?
আল্লাহই একমাত্র ভালো জানেন।
তারা ছাত্র পেয়েছে তো পড়াচ্ছি তো পড়াচ্ছি।
আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি প্রতিবছর ৫০ থেকে ৬০ জন ছেলেদেরকে ফেরত দিতে হয়। আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করতে পারি না। কারণ তাদের বয়সে কুলায় না। আলিয়ার বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী একজন ছেলেকে অষ্টম শ্রেণী পাস করতে হবে ১৭ বছরের ভিতরে অর্থাৎ 17 বছর হওয়ার আগেই। সেক্ষেত্রে ১৭-১৮ বছরের একটা ছেলে যখন । হাফিজি শেষ করে অথবা ।অর্ধেক অবস্থায়
আলিয়ায় ভর্তি হতে আসে অথচ তার পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত কোনো সার্টিফিকেট থাকে না। তখন সেআলিয়া লাইনে আর পড়তে পারছে না ।আবার অনেকে । কওমি মাদ্রাসায় রাজি না। সেক্ষেত্রে একটা বড় জটিলতা দেখা যায়।
ইদানিং কিছু মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে যারা হেফজের সাথে জেনারেল লাইনেরও পড়াশোনা করান।
এটা ভালো উদ্যোগ। কারণ সব ছাত্রই হেফজ
খানা থেকে কওমি লাইনে পড়বে বিষয়টি এমন না। যারা আলিয়া লাইনে পড়তে চায় হেফজের পাশাপাশি অন্য বিষয় গুলি পড়াশোনা থাকলে আলিয়াতে এসে ভালো করে। সেক্ষেত্রে এক দুই বছর বেশি লাগলেও তাদের জন্য এটা সুবিধা জনক।
এ সুযোগে কোন কোন হাফিজিয়া মাদ্রাসায় বয়স বেশি হয়ে গেল যাদের হেফজ শেষ হয় না তাদেরকে ষষ্ঠ সপ্তম শ্রেণীতে নিজেরা পড়াশোনা ব্যবস্থা করছেন অথচ এই ব্যবস্থাটা তাদের পূর্ণাঙ্গ না। এবং আইনিও কোনো ভিত্তি নাই ।
আমি এমনও পেয়েছি হাফিজি মাদ্রাসা থেকে সপ্তম শ্রেণীর সার্টিফিকেট নিয়ে আসছে বললাম কোন ক্লাস থেকে পড়ে আসছে । বললো সপ্তম শ্রেণী পাস করে আসছি ।সার্টিফিকেটে লেখা আছে সে সপ্তম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছে। আমি বললাম মার্কশিট নিয়ে আসো। দেখলাম সপ্তম শ্রেণীতে সে মাত্র চারটি বিষয় পড়েছে বাংলা গণিত, ইংরেজি, আরবির একটি বিষয়। অথচ সপ্তম শ্রেণীর মাদ্রাসাগুলিতে ১৩ টি বিষয় পড়ানো হয়। তাহলে তারা যে সপ্তম শ্রেণীর সার্টিফিকেট দিয়ে দিল এটা এক ধরনের প্রতারণা। এবং এটা অধিকার বহির্ভূত, শিক্ষার্থীর জন্য ক্ষতিকর। কারণ তিনি এটা দেয়ার এখতিয়ার রাখেন না যে সপ্তম শ্রেণী পড়ানোর কোন অনুমতিও তার নেই। মাদ্রাসা বোর্ডের বই কোথা থেকে সংগ্রহ করল তারও কোন নিমতান্ত্রিক পন্থা নেই।
সাধারণ হাফিজিয়া খানায় ভর্তি হওয়া ১০০ ছাত্রের মধ্যে ২০ জন হাফেজ হচ্ছে কিনা এটা কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ বাকি ছাত্ররা যাচ্ছে কোথায় ?এদের একটা বড় অংশ পড়াশোনা বিমুখ হয়ে পড়ে। একবার ভর্তি হলে পরে মাদ্রাসা থেকে অনেকেই ছাড়তে চান না ।তাকে পড়াচ্ছেন তো পড়াচ্ছেনই। তার বয়স কোন দিকে যাচ্ছে ভবিষ্যতে সে কি হবে কি করবে এই নিয়ে কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। ছাত্র আছে মাদ্রাসা চলছে, চালাচ্ছে।
একজন শিক্ষার্থী হেফজ করলো বড় একটা কাজ করেছে। অনেক সোওয়াবের কাজ ,অনেক সম্মানীয় কাজ। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষিতে দরিদ্র ফ্যামিলি গুলি থেকে এই ছেলেগুলি যখন হেফজ করে বের হয় ।তখন তার একটা কর্মসংস্থান জরুরি হয়ে পড়ে শুধুমাত্র হাফেজি পড়ে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রগুলি কোন কোন জায়গায় এটা আমার ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই।
হাফিজি পড়ার পর সে যদি কওমি লাইনেও মুফতি ,মুহাদ্দিস বা ফকীহ হতে পারেন তাহলে অবশ্যই এটা ভালো দিক। তাকে আলিয়া লাইনেই পড়তে হবে আমি এটা খুব বেশি জরুরী মনে করি না। কিন্তু হাফিজির পরে তাকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে এটা অন্তত জরুরি বলে মনে করি। অন্যথায় সে যে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে ।কোরআন মুখস্ত করেছে ।এই গুরুত্বটুকু ভুলে যায়। এমনকি অনেকে হাফিজি ও ভুলে যায়। এ কারণে তাকে আলিয়া লাইনে কমপক্ষে কামিল পাস অথবা কাওমি লাইনে কমপক্ষে দাওরা পাস করা উচিত।
সে ক্ষেত্রে বয়স, আর্থিক সামর্থ্য মেধা এই বিষয়গুলি অবশ্যই বিবেচ্য।
তাহলে আমরা কি হাফেজিয়ায় দেব না?
আমার উত্তর হলো অবশ্যই হাফিজি খানায় বাচ্চাদেরকে দিতে হবে।
এক্ষেত্রে আমার কিছু অবজারভেশন এবং পরামর্শ আমি নিম্নে তুলে ধরলাম।
প্রথমত: প্রত্যেকটি বাচ্চাকেই ছোট সময়ে যখন আমরা কিন্ডারগার্টেনে দেই এই বয়সে হাফিজি খানায় ভর্তি করানো উচিত। সম্ভব হলে রাত্রে না রাখা। ২-৩ বছর একটানা পড়ানো। এর সাথে সাধারণ লাইনের কিছু বিষয় পড়ানো এরপর দুই তিন বছর পরে ওস্তাদদের মধ্যে যাদের সান্নিধ্য এই ছাত্ররা পেয়েছে তাদেরকে নিয়ে উচ্চ পর্যায়ে মাদ্রাসাতে একটা বোর্ড বসে সিদ্ধান্ত নিবে যে এই ছেলেটিকে হাফেজ বানানো সম্ভব কিনা। থাক তার দ্বারা হাফেজ হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা যাচাই করা। যদি কিছুটা সম্ভাবনা থাকে তাহলে রাখা অন্যথায় তাকে কিতাব লাইনে অথবা আলিয়া লাইনে ভর্তি করে দেওয়া ।কিন্তু আমার জানামতে হাফিজি মাদ্রাসাগুলি থেকে অভিভাবক দেরকে ডেকে অন্য কোথাও নিয়ে যাক এমনটি করা হয় বলে আমার জানা নাই।
দ্বিতীয়তঃ হাফিজি মাদ্রাসা গুলি পরিচালনার একটা বোর্ড থাকা দরকার এখানকার শিক্ষকদের ন্যূনতম যোগ্যতার বিষয়ে একটা সনদের ব্যবস্থা থাকা দরকার যে কেউ ইচ্ছা করলে যেন হেফজখানা খুলে বসতে না পারে। সে ব্যবস্থা করা। পরিবেশ ওস্তাদদের মান সবকিছু মিলিয়েই একটা হাফিজ খানা খোলার অনুমতি দেয়া দরকার। এজন্য কওমি লাইনের ওস্তাদের নিয়ে একটি ভোট জেলা ভিত্তিক এবং আলিয়া লাইনের ওস্তাদের নিয়ে একটি বোর্ড জেলা ভিত্তিক হতে পারে এক্ষেত্রে সরকারি শিক্ষা অফিসার এর সহযোগিতা নিয়ে যেতে পারে।
এক্ষেত্রে সমাজের বিত্তবানদের কে এগিয়ে আসা দরকার।
দ্বীনি এ সকল প্রতিষ্ঠানগুলো যেন খুব বেশি বাণিজ্যিক হয়ে না উঠে সেদিকেও তদারকি থাকা দরকার।
তৃতীয়ত:একটা নির্দিষ্ট বয়সের পরে তাকে অন্য ভাবে পড়াশোনার সুযোগ করে দেওয়া পাশাপাশি কর্মসংস্থানের জন্য উপযুক্ত করে করে তোলা।
চতুর্থত:এখতিয়ার বহির্ভূত সপ্তম শ্রেণী অষ্টম শ্রেণী না খুলা । জেনারেল লাইন খুলে যথোপযুক্ত শিক্ষাদান করতে না পারলে এটা হবে এক ধরনের প্রতারণা। এই প্রতারণা থেকে বিরত থাকা দরকার। আপনি যেই ক্লাসের সার্টিফিকেট দিচ্ছেন অথচ সেই ক্লাসের সিলেবাস কারিকুলাম আপনি পূর্ণ করছেন না আপনি নিজের মতন করে প্রশ্ন করে সার্টিফিকেট দিয়ে দিবেন বাস্তবতার সাথে এসে সে প্রতি পদে পদে সমস্যার সম্মুখীন হবে এর দায়ভার কে নিবে ?এজন্য যতটুকু সামর্থ্য আছে ততটুকু শিক্ষা দান করা। প্রয়োজনে সামর্থ্য, সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
পঞ্চমত: সকল শ্রেণীর কক্ষ আবাসন কক্ষ সিসি ক্যামেরায় অন্তর্ভুক্ত করা।
ষষ্ঠত: ইমমিচিউড বাচ্চাদেরকে দিয়ে কালেকশন না করানো।
হাফিজিয়া মাদ্রাসা গুলি গড়ে উঠুক সুন্দরভাবে সেখান থেকে অসংখ্য হাফেজ বের হউক। কোরআনের সুর ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে ,। কোরআনের পাখিদের কলাকাগুলিতে ভরে উঠুক সকল মাদ্রাসার আঙ্গিনা এবং তারা দিনের খেদমতে ভূমিকা রাখুক সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। আল্লাহ হাফেজ।
সহকারী অধ্যাপক (অর্থনীতি)
জামেয়া কাসেমিয়া কামিল মাদ্রাসা, নরসিংদী।
Leave a Reply